শাহেদ মিজান, সিবিএন:
পরিবেশ হুমকির কারণে প্রবাল দ্বীপ সেন্টমার্টিন নিয়ে সরকার কড়াকড়ি উদ্যোগ নিয়েছে। মার্চ থেকে সেখানে রাত্রী যাপন নিষিদ্ধ করা হয়েছে। এছাড়াও আরো বিধি-নিষেধ আরোপ করা হয়েছে। তবে পর্যটন সংশ্লিষ্ট বলছেন, সেন্টমার্টিনে পর্যটন গমণে কড়াকড়ি বাড়লে তার প্রভাব পড়বে পুরো কক্সবাজারের পর্যটন শিল্পে। কেননা কক্সবাজারের পর্যটন শিল্পের প্রধান আকর্ষণ সেন্টমার্টিন। সেন্টমার্টিনকে ঘিরেই কক্সবাজার ভ্রমণের ছক তৈরি করেন পর্যটকেরা।
জানা গেছে, গত ২৬ অক্টোবর প্রবাল দ্বীপ সেন্টমার্টিনে জাহাজ চলাচল শুরু হয়েছে । এর মধ্যে চলতি মৌসুমের পর্যটন শিল্পে এক উদ্দীপনা দেখা দিয়েছে। কেননা সেন্টমার্টিনে জাহাজ চলাচলের সাথে সাথে কক্সবাজারে পর্যটকের আনাগোনা বেড়েছে। এতে করে এখানকার পর্যটন শিল্পে নতুন উদ্দীপনা সৃষ্টি হয়েছে। পর্যটন ব্যবসায়ীদের মাঝে চলছে তোড়জোড়। তবে শঙ্কা দেখা দিয়েছে জাতীয় নির্বাচনকে কেন্দ্র করে দেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতি অস্থিতিশীল হয়ে ফের মুখ থুবড়ে পড়তে পারে পর্যটন শিল্প। এর পাশাপাশি সেন্টমার্টিনে মার্চ থেকে রাত্রী যাপন নিষিদ্ধ ঘোষণাও কক্সবাজারের পর্যটন শিল্পে নেতিবাচক প্রভাব পড়তে পারে।
ট্যুর অপারেটস এসোসিশেয়ন অব কক্সবাজারের (টুয়াক) সাধারণ সম্পাদক আসাফ-উদ-দৌলা আশেক জানান, প্রায় ছয় মাস বন্ধ থাকার পর প্রবালদ্বীপ সেন্টমার্টিনগামী জাহাজ চলাচল শুরু হয়েছে। চলতি মৌসুমের প্রথমে দুটি জাহাজে করে ৫২২ পর্যটক সেন্টমার্টিন যাত্রা করে। শুক্রবার দুপুর ১২টার দিকে কেয়ারি ক্রুজ অ্যান্ড ডাইন ও বে-ক্রুজ সেন্টমার্টিন পৌঁছায়। শনিবারও একই পরিমাণ পর্যটক সেন্টমার্টিন গেছেন।
আসাফ-উদ-দৌলা আশেক আরো জানান, অক্টোবর থেকে পর্যটন মৌসুম শুরু হলেও এতদিন তেমন পর্যটক আসেনি। ২৬ অক্টোবর সেন্টমার্টিনে জাহাজ চলাচলের সাথে সাথে বেড়ে যায় পর্যটকের সংখ্যা। সেন্টমার্টিনের জাহাজ চলাচল ঘোষণার পর থেকে পর্যটকেরা কক্সবাজারে বেড়াতে আসার বুকিং শুরু করেন। এর মধ্যে বিপুল সংখ্যক পর্যটক কক্সবাজারে আসার প্রস্তুতি নেন। ২৬ অক্টোবর জাহাজ চলালচল শুরুকে সামনে এসব পর্যটকেরা কক্সবাজারে বেড়াতে আসে। শুক্র ও শনিবার কক্সবাজারে বিপুল সংখ্যক পর্যটক এসেছেন। এদের অধিকাংশই সেন্টমার্টিন গেছেন।
এদিকে গতকাল শনিবার কক্সবাজারে এক সভায় সেন্টমার্টিন দ্বীপবাসী এবং পর্যটন সংশ্লিষ্ট ব্যবসায়ীদের উদ্দেশ্যে পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তনমন্ত্রী আনিসুল ইসলাম মাহমুদ বলেন, আগামী বছরের ফেব্রুয়ারী মাস পর্যন্ত আমরা দেখবো আপনারা দ্বীপে পর্যটকদের যাতায়াত ও রাত্রী যাপন কতটুকু কমিয়ে আনতে পারেন। যদি দেখি, আমরা যেভাবে চাচ্ছি সেভাবে নিয়ন্ত্রণে এবং শৃঙ্খলায় চলে আসছে তাহলে মার্চের শুরুতে রাত্রী যাপনের নিষেধ আরোপের বিষয়ে ভিন্ন সিদ্ধান্ত হতে পারে।
মানুষের অবাধ বিচরণ, মাত্রাতিরিক্ত অবকাঠামো উন্নয়নসহ বিভিন্ন কারণে দিনদিন পরিবেশ ও জীববৈচিত্র ধ্বংস হয়ে যাওয়া কারণে চরম অস্থিত্ব সংকটে দেশের একমাত্র কোরাল দ্বীপ সেন্টমার্টিন। দ্বীপ রক্ষায় সম্প্রতি সেখানে পর্যটকদের যাতায়াতে নিয়ন্ত্রণ এবং রাতযাপনে নিষিদ্ধ করার বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেয় আন্তঃ মন্ত্রণালয়। এই সিদ্ধান্ত আগামী বছরের ১ মার্চ থেকে বাস্তবায়ন হওয়ার কথা। ওই সিদ্ধান্তের পর থেকে সেন্টমার্টিন দ্বীপের মানুষ এবং পর্যটন সংশ্লিষ্ট ব্যবসায়ীদের মধ্যে চরম ক্ষোভ বিরাজ করছে। ক্ষুব্ধ সেন্টমার্টিনের মানুষ ইতোমধ্যে কয়েক দফায় মানববন্ধনও করেছে।
ট্যুর অপারেটস এসোসিশেয়ন অব কক্সবাজারের (টুয়াক) প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি এস.এম কিবরিয়া বলেন, ‘সেন্টমার্টিন হচ্ছে কক্সবাজারের পর্যটন শিল্পের প্রাণ। সমুদ্র সৈকত ছাড়াও সেন্টমার্টিনের টানে পর্যটকেরা কক্সবাজার বেড়াতে আসেন। কিন্তু সেন্টামার্টিন নিয়ে কড়াকড়ি বাড়ায় পর্যটকেরা হতাশা প্রকাশ করছেন। এর প্রভাব পড়ছে পর্যটন ব্যবসায়ীদের মাঝেও। কেননা মার্চ থেকে সেন্টমার্টিনে পর্যটকদের রাত্রী যাপন নিষিদ্ধ হলে তা পুরো পর্যটন শিল্পে মারাত্মক বিরূপ প্রভাব পড়বে। কেননা রাত্রী যাপন করতে না পারলে পর্যটকেরা সেন্টমার্টিনে যেতে চাইবে না। কারণ একই দিনে যাওয়া-আসাতে দিনটা চলে যাবে। উপভোগের আর কোনো সময় থাকবে না। এতে পর্যটকেরা কক্সবাজার বিমুখ হয়ে পড়বে।’
সেন্টমার্টিন ইউপি চেয়ারম্যান নুর আহমদ বলেন, ‘২২০ বছর ধরে সেন্টমার্টিন দ্বীপে আমরা বসবাস করে আসছি। বর্তমানে সেখানে ১৪৫৪ পরিবারে প্রায় সাড়ে ৯ হাজার মানুষের বসবাস। এটি আমাদের জন্মভূমি। আন্তঃমন্ত্রণালয়ে যে সিদ্ধান্ত নিয়েছে, সেটি আমাদের গলাটিপে হত্যা করার মত। মন্ত্রণালয়ে বসে এভাবে সিদ্ধান্ত না নিয়ে আমাদের সাগরে ভাসিয়ে দিন। কারণ সিদ্ধান্তটি বাস্তবায়ন হলে আমাদের অবস্থা রোহিঙ্গাদের চেয়েও খারাপ হয়ে যাবে। আমরা রোহিঙ্গা হতে চায় না, আমরা স্বাধীন দেশের মানুষ।’
চেয়ারম্যান নুর আহমদ আরো বলেন, ‘পর্যটনের উপর দ্বীপের মানুষের জীবিকা নির্ভর করে। পর্যটক যাতায়াত বন্ধ করে দিলে দ্বীপবাসী না খেয়ে মারা যাবে। তাই সিদ্ধান্ত গুলো পুর্নবিবেচনা করতে হবে। এবং দ্বীপের মানুষের মৌলিক অধিকার অক্ষুন্ন রেখে এমন একটি নীতিমালা তৈরী করতে হবে যাতে আমরা পরিবেশ সম্মতভাবে বসবাস এবং পর্যটন ব্যবসা চালু রাখতে পারি।’
সেন্টমার্টিন ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সভাপতি মুজিবুর রহমান বলেন, ‘সেন্টমার্টিনে পর্যটক যাতায়াত বন্ধ হলে দ্বীপের ৭০ ভাগ মানুষ ভিক্ষা করবে। একটা সময় না খেয়ে মারা যাবে। পর্যটন ব্যবসা চালু হওয়ার কারণে দ্বীপের ছেলে মেয়েরা পড়াশোনা করছে। উচ্চ শিক্ষার্জনের সুযোগ পাচ্ছে। এই দ্বীপের মানুষকে অন্যায়ভাবে বিপদের মুখে ঠেলে দিলে একদিন কঠিন জবাবদিহিতার মুখোমুখি হতে হবে।’
কক্সবাজার হোটেল-মোটেল গেস্ট হাউজ মালিক সমিতির সাধারণ সম্পাদক আবুল কাশেস সিকদার বলেন, ‘পর্যটক গমণ নিষিদ্ধ নয়; পর্যটকের অবস্থান ঠিক রেখেই সেন্টমার্টিনের পরিবেশ বজায় রাখতে হবে। সরকার চাইলে এটা সম্ভব হবে। পরিকল্পিতভাবে মাস্টার প্ল্যান করে এই কাজটা করা যাবে। মনে রাখতে হবে সেন্টমার্টিনে পর্যটক গমণে প্রতিবন্ধকতা হলে তার কক্সবাজারের পুরো পর্যটন শিল্পে বিরূপ প্রভাব পড়বে।’
আমরা সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।